হাসান আজিজুল হকের উপন্যাস ভাবনা

প্রকাশিত: ৬:০৩ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ১৯, ২০২১

হাসান আজিজুল হকের উপন্যাস ভাবনা

বাংলা সাহিত্যের অসামান্য কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হকের মৃত্যু আক্ষরিক অর্থেই শূন্যতা তৈরি করেছে আমাদের সাহিত্যে। ছোটগল্পের মুকুটহীন সম্রাট ছিলেন তিনি। এমন শিল্প সাফল্যের পরও তিনি মাত্র দুটি উপন্যাস লিখেছেন জীবনসায়াহ্নে উপনীত হয়ে। এমন কঠোর সংযম ও আশ্চর্য পরিমিতিবোধ একজন মহৎ শিল্পীই শুধু দেখাতে পারেন। হাসান আজিজুল হক অসামান্য ছিলেন একজন চিন্তাবিদ হিসাবেও। পেশায় দর্শনের অধ্যাপক ছিলেন। দর্শন, সাহিত্য, সমাজ, রাষ্ট্র নিয়ে নিরন্তর ভেবেছেন। সাহিত্য বিশেষত উপন্যাস নিয়ে তার ভাবনা অত্যন্ত চিন্তা উদ্দীপক। মনে রাখতে হবে যে উপন্যাস নিয়ে নিজস্ব ভাবনা-চিন্তার উজ্জ্বল বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন নিজে উপন্যাস লেখার আগে। অর্থাৎ সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়েই তিনি উপন্যাস লিখেছেন।

প্রাবন্ধিক হিসাবে অপূর্ব কুশলতার স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি ‘কথাসাহিত্যের কথকতা’ ও ‘অপ্রকাশের ভার’ বইয়ে। বাংলা উপন্যাস নিয়ে তার স্ফটিকস্বচ্ছ ভাবনার পরিচয় পাওয়া যায় বই দুটিতে। বাংলা উপন্যাসের ধারাকে তিনি শ্যেন চক্ষুতে অবলোকন করেছেন। ‘কথাসাহিত্যের কথকতা’ বইয়ের প্রথম প্রবন্ধে মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ববর্তী বাংলাদেশের উপন্যাসকে তিনি পর্যালোচনা করেছেন। সেই সময়ের খ্যাতিমান ঔপন্যাসিকদের সম্পর্কে তীব্র ও নির্মোহ মন্তব্য করেছেন। এক পর্যায়ে বলেছেন-‘বাঙালি ঔপন্যাসিক ঘটনার ছিবড়ে নিয়ে টানাটানি করেছেন, দেশের সংকটের মূলে কখনো যাননি।’

বিংশ শতাব্দীর চারের ও পাঁচের দশকের ঔপন্যাসিকদের মধ্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ যে সবচেয়ে প্রতিভাবান ও শক্তিমান সে কথা তিনি জোর দিয়ে বলেছেন। তার বিবেচনায়-“…বাংলাদেশের উপন্যাসে কীভাবে অচেতন প্রয়াসের ক্লান্তিকর অনুবর্তনের মধ্যে প্রথম সচেতন শিল্পীর পদপাত ঘটে তা বুঝতে গেলে আমাদের সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর রচনার সঙ্গে পরিচিতি হতে হবে। জীবননিষ্ঠা ও আধুনিক শিল্পপ্রকরণ, তীব্র শৈল্পিক সচেতনতা ও দক্ষতা, স্নায়ু-ছেঁড়া সংযম ও পরিমিতিবোধ, নিচু ও নির্বিকার উচ্চারণ-আধুনিক সুনির্মিত উপন্যাসের সব বৈশিষ্ট্য সৈদয় ওয়ালীউল্লাহতে পাওয়া যায়। ‘লালসালু’ উপন্যাস প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের উপন্যাস আধুনিক কথাসাহিত্যে প্রবেশ করে।”

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সাফল্য সূত্রকে তিনি চিহ্নিত করেন এভাবে-“সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর কৃতিত্ব একজন সমাজবিজ্ঞানীর কিন্তু ততোধিক বোধহয় একজন বড় শিল্পীর। মিতভাষণ, অন্তর্ভেদী দৃষ্টি, শাণিত, ঋজু ও ধনুকের জ্যা-র মতো টানটান বাক্যবন্ধ, অন্তর্লীন আবেগের প্রচণ্ড চাপ, মোহহীন বুদ্ধিদীপ্ত মনোভঙ্গি এবং অনন্য লক্ষ্য দৃঢ় নির্মাণ-সাফল্য-ইত্যাদি বহুবিধ সিদ্ধি অর্জনে ‘লালসালু’র লেখক এমন কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন যে তাকে ভাবালু বাঙালি ঔপন্যাসিকদের দলভুক্ত করতেই অসুবিধা হয়। ব্যক্তির মনের ভেতরটায় আলো ফেলে তন্নতন্ন অনুসন্ধানের কাজটাও তিনিই প্রথম করেন। শত বাসনা, লোভ, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, অপ্রতিহত কাম সবই যে মনের গুহায় অতল অন্ধকারের মধ্যে লুকিয়ে থাকে তা প্রায় সিদ্ধান্তের আকারে তিনি আমাদের সামনে হাজির করেন।” কিন্তু ওয়ালীউল্লাহ যে পরবর্তী দুটি উপন্যাস দৈশিক বাস্তবতার সঙ্গে পাশ্চাত্য আধুনিকতার সমন্বয় ঘটাতে পারেননি, কামুর প্রভাবের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করেন-এমন অভিযোগও করেছেন হাসান। ‘চাঁদের অমাবস্যা’ ও ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাসের ঐশ্বর্য ও শক্তি স্বীকার করেও হাসান বলেন ওয়ালীউল্লাহ বাংলাদেশ ও বাঙালির ঔপন্যাসিক থাকেন না শেষ পর্যন্ত। তার মনোভাব শুধু নয়, উপন্যাসের স্থূল শরীরেও স্পষ্ট হয়ে ওঠে বিদেশি উপস্থিতি। তার সম্পর্কে হাসানের নিরাসক্ত মূল্যায়ন-‘চাঁদের অমাবস্যা বা কাঁদো নদী কাঁদো বিদেশে বসে শক্ত কলমে অসাধারণ বাংলাভাষার লেখা ইউরোপীয় উপন্যাস।’

অর্থাৎ হাসান আজিজুল হক খাঁটি বাংলাভাষায় বাঙালির অকৃত্রিম উপন্যাস চান যা একই সঙ্গে দেশজ মৃত্তিকা ও কালসংলগ্ন। তার সচেতন জিজ্ঞাসা-“কোনো মতেই কি আমাদের কথাসাহিত্যকে জীবনের সঙ্গে, বাঁচার আনন্দ, বেদনা, যন্ত্রণা, উপভোগ, ভালোবাসা, ঘৃণার সঙ্গে যুক্ত করতে পারি না আমরা?

ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের জয় ঘোষণা করে ‘বুর্জোয়া আর্ট ফর্ম’রূপে পাশ্চাত্যে একদিন উপন্যাস শিল্পের অভ্যুদয় ঘটেছিল। মানুষের প্রাতিস্বিক সত্তা ও বোধের জাগ্রত হওয়ার ফসল উপন্যাস। উপন্যাসে একদিকে যেমন যুক্ত হয়েছে ঔপন্যাসিকদের ব্যক্তিগত জীবনাভিজ্ঞতা, তেমনি যুক্ত হয়েছে সাংস্কৃতিক ইতিহাসের উপাদান। উপন্যাসের বহুতলবিশিষ্ট দায়ের মধ্যে একমাত্র অন্বিষ্ট হচ্ছে মানুষ এবং মানুষের জীবনের কেন্দ্রমূল অনুসন্ধান। সমাজ ও স্বকালের কাছে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েও আধুনিক ঔপন্যাসিক এ দুইয়ের ভেতর দিয়ে ব্যক্তিমানুষ সঙ্গতি আবিষ্কারের প্রতি বেশি সচেষ্ট। জীবনের অতল্য রহস্য উন্মোচনে পারঙ্গম হাসান আজিজুল হক যথার্থই বলেছেন-‘কথাসাহিত্যিকের কাজ তাই জাদুর কাঠি বুলিয়ে বাস্তবকে ভুলিয়ে দেওয়া হতে পারে না বরং তার পালন করা উচিত শল্যচিকিৎসকদের নিষ্ঠুর নিস্পৃহ ভূমিকা। সমকালীন জীবনের বাস্তবতার ছবি আঁকাই নয় শুধু, এমনকি সামগ্রিক ছবি দেওয়াও নয়, তার কাজ সমকালীন জীবনকে আমূল কেটে কেটে বিশ্লেষণ করে দেখানো, সবক’টি স্তর, সব রকম আঁশ, তার গভীরতম স্বরূপ, জীবনের সব তন্তু আলাদা করে ফেলা এবং একেবারে চোখের সামনে আনা। এ বিশিষ্ট করার কাজের পর তার জন্য থেকে যায় সংশ্লেষণের সংযোজনের কাজ-না হলে সমগ্র পাওয়া যায় না-সমগ্রে সমগ্র এবং অংশে প্রতিফলিত সমগ্র।’

হাসান আজিজুল হক জানেন যে, ‘ফর্মের’ ইতিহাস শিল্পের ইতিহাস নয়। সমাজে চলিষ্ণুতাই নতুন প্রসঙ্গের জন্ম দেয়। বাতিল করে পুরোনো প্রসঙ্গ, হাজির করে নতুন কথা। হাসান বিশ্বাস করেন-‘লেখক একটু নিষ্ঠুর হলেও ক্ষতি নেই, আমাদের সমাজের মধ্যে যে বিকট অমানবিকতা, পাকাপোক্ত নিষ্ঠুরতা এবং পাশবিকতা আছে, স্যাঁতসেঁতে ভিজে হৃদয় নিয়ে তার সম্মুখীন হওয়া কোনো লেখকের পক্ষে সম্ভব নয়। আমার কিন্তু সেসব দয়ালু, সৌন্দর্যপিপাসু, শিল্পসন্ধানী, ভাবে গদগদ লেখকদেরই নিষ্ঠুর মনে হয় যারা জীবনের এবং সমাজের ভেতরের স্থায়ী অমানবিক ব্যবস্থাটিকে কখনো দেখতে পান না অথচ লেখার বিষয়ের অভাব যাদের কখনো হয় না।’

এ জনপদের মাটি ও মানুষের আবহমান সংগ্রামের দক্ষ রূপকার হাসান আজিজুল হক। সস্তা জনপ্রিয়তার মোহ তাকে কখনো আচ্ছন্ন করেনি। আমাদের সাহিত্যের লোকরঞ্জনবাদী ধারার দুর্বলতাটি দেখিয়ে তিনি বলেছেন-‘চাই বিনোদন ও আনন্দের সাহিত্য এ জিগির প্রায় শোনা যায়। আমার ধারণা শিল্প বা সৌন্দর্যের প্রশ্নটিকে সুকৌশলে এ ধ্বনির সঙ্গে সচরাচর জুড়ে দেওয়াও হয় যেন শিল্প বা সৌন্দর্য সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন একটি বিষয়, যেন সাহিত্যের শিল্প ও সৌন্দর্য আনন্দ বিতরণেই নিঃশেষিত, তারা শুধু বাস্তবকেই ভুলিয়ে দেয়, আমাদের টেনে নিয়ে যায় স্বপ্নের কুহকে। বাস্তব জগৎ থেকে সাহিত্যকে সরাতে পারলেই দেখা যাবে শিল্প ও সৌন্দর্য, এমন বিশ্বাসও কাজ করে আমাদের অনেকের মধ্যে। কিন্তু কথাসাহিত্যের পক্ষে তা কখনো সম্ভব হয় না, সমকালীন জীবন তার গায়ে লেগে থাকে নাছোড় হয়ে -মাঝখান থেকে জীবন ও শিল্প এ দু’কূল আলাদা ধরে নিয়ে সামলাতে গিয়ে জীবনের পঙ্গ, বিকৃত, আংশিক একটি ছবিই দেখা দেয় লেখায়। লেখক তখন হয়ে দাঁড়ান ভাঁড় বা ময়রা। ভাঁড় হয়ে সাহিত্য পাঠকের মনোরঞ্জন করা, না হয় ময়রা হয়ে রসালো খাদ্যের জোগান দিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।’ না, পাঠকের মনোরঞ্জন করা সস্তা পথে কখনো হাঁটেননি হাসান। তিনি সদাজাগ্রত লেখক, পাঠককেও জাগ্রত করার সংশপ্তক ব্রত নিয়ে আজীবন সাহিত্যসাধনা করেছেন। প্রায় চার দশক আগে কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান সাক্ষাৎকার গ্রহণকালে হাসানকে মনে করিয়ে দিয়েছেন যে ‘শামুক’, ‘এইসব দিনরাত্রি’ নামে তিনি লেখক জীবনের শুরুতে উপন্যাস লিখেছিলেন, কিন্তু গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেননি। জবাবে হাসান বলেছিলেন, ‘ওগুলোকে আমি আর ছাড়পত্র দিতে চাই না… ওগুলো পড়লে এখন মনে হয় পুরো ব্যাপারটা আবেগে খুব স্যাঁতস্যাঁতে … আমার ধারণা এখন বাস্তব অনেক রূঢ় আর তাকে মোকাবিলাও করা দরকার শুকনো খটখটে, ডাঙ্গায় দাঁড়িয়ে।’

নিজের রচনা সম্পর্কে এমন নির্মোহ ও নির্মম হতে পারার উদাহরণ একান্ত দুর্লভ। এ দুর্লভ বৈশিষ্ট্যই হাসান আজিজুল হককে অসামান্য উচ্চতায় উন্নীত করেছে। তার উপন্যাস সংক্রান্ত ভাবনার নির্যাসটুকু যদি এ কালের কথাসাহিত্যিকরা গ্রহণ করতে পারেন, তাহলে নিঃসন্দেহে আমাদের সাহিত্য আরও সমৃদ্ধ হবে।