আজ ৯ ই ডিসেম্বর জগন্নাথপুর মুক্ত দিবস

প্রকাশিত: ১১:৫০ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ৮, ২০২৪

আজ ৯ ই ডিসেম্বর জগন্নাথপুর মুক্ত দিবস

হুমায়ূন কবীর ফরীদি ##

আজ ৯ ই ডিসেম্বর জগন্নাথপুর মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলা পাক-হানাদার মুক্ত হয়। অকুতোভয় দুঃসাহসী স্বাধীনতাকামী বাঙালী যোদ্ধাদের কাছে রাজাকার, পাক-সেনারা এইদিন আত্মসমর্পন করে। জগন্নাথপুরে পতপত করে ওড়ে স্বাধীনতার লাল সবুজের পতাকা। জগন্নাথপুর থানায় প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন জগন্নাথপুর থানার প্রথম বেসামরিক প্রশাসক উপজেলার ইকড়ছই গ্রাম নিবাসী ব্যারিস্টার প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা মির্জা আব্দুল মতিন। দেশ স্বাধীনের পর থেকে প্রতিবছর ৯ ই ডিসেম্বর জগন্নাথপুর মুক্ত দিবস পালন হয়ে আসছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয়দের তথ্যমতে, ১৯ ৭১ সালের ২৭ শে আগস্ট প্রায় পাঁচ শতাধিক পাক-হানাদর বাহিনী সবুজ শ্যামলের ছায়া ঘেরা জগন্নাথপুরে আসে। এবং ওরা জগন্নাথপুর থানা আক্রমণের পরিকল্পনা করে। ২৮ আগস্ট সকালে ফাঁকা গুলি ছুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে জগন্নাথপুর থানায় প্রবেশ করে। এক পর্যায়ে থানা এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। এদিনই পাক – হানাদার বাহিনী অর্থাৎ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় রাজাকাররা ইকড়ছই মির্জা বাড়ী সহ জগন্নাথপুরের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাসা- বাড়িতে লুটপাট চালায়। পরদিন ২৯ শে আগস্ট আবারও পাকবাহিনী মির্জা বাড়িতে হামলা চালিয়ে ৫টি ঘর ভাংচুর করে সেখানে একটি ক্যাম্প স্থাপন করে।
স্বাধীনতা যুদ্ধে জগন্নাথপুরে ইতিহাসের বর্বরতম দুটি গণহত্যা সংগঠিত হয়। একাত্তরের ৩১ শে আগস্ট শ্রীরামসি ও ১ লা সেপ্টেম্বর রাণীগঞ্জ বাজারে পাক হানাদাররা চালায় পরপর দুটি বর্বর হত্যাযজ্ঞ। রাজাকারদের সহযোগিতায় তারা সুক্ষ্ম কৌশলে শত শত মানুষকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে হত্যা করে। সেই নিষ্টুর নারকীয় হত্যাযজ্ঞ আজো জগন্নাথপুরের মানুষের হৃদয়ে নাড়া দিয়ে উঠে। পাকবাহিনী জগন্নাথপুর বাজারেও একটি গণহত্যা চালানোর প্রস্তুতি নিয়েছিল। এজন্য তারা দুই শতাধিক ব্যবসায়ীকে নলজুর নদীর তীরে নিয়ে হাত-পা বেঁধে লাইনে দাঁড়ও করায়। কিন্তু কোনো কারণেই হোক শেষ পর্যন্ত গণহত্যাটি সংগঠিত হয়নি। তবে তারা জগন্নাথপুর বাজারে ব্যাপক লুটপাট চালায়। এক পর্যায়ে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। কাবু হতে থাকে পাক বাহিনী। ৯ ডিসেম্বর মিরপুরে পাকবাহিনীর সঙ্গে এক যুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে জগন্নাথপুর থানাকে পাক হানাদার মুক্ত ঘোষণা করা হয়। নৌপথে ও সড়কপথে সিলেটের দিকে পালিয়ে যায় তারা। থানা এলাকা শত্রুমুক্ত হওয়ায় সেদিন জনতা রাস্তায় নেমে এসে বীর সন্তানদের স্বাগত জানায়।জগন্নাথপুর থানায় প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন ইকড়ছই মির্জা বাড়ির সন্তান ব্যারিস্টার প্রয়াত মির্জা আব্দুল মতিন।
হানাদারদের নৃশংসতা ও রাজাকারদের অপৎপরতার বিরুদ্ধে এ অঞ্চলের মুক্তিকামী জনগণের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। জগন্নাথপুর মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রাখেন- সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রয়াত আব্দুস সামাদ আজাদ, সাবেক এমপি প্রয়াত এডভোকেট আব্দুর রইছ, ব্যারিস্টার বীর মুক্তিযোদ্ধা মির্জা আব্দুল মতিন, আব্দুল কাদির শিকদার, আব্দুল কাইয়ুম, ব্যরিস্টার মির্জা আব্দুল ওয়াহিদ, মির্জা আব্দুল ছত্তার, বাদল চৌধুরী, হারুনুর রশীদ হিরন মিয়া, আব্দুল মোতালেব চৌধুরী বাচ্চু, মাহবুবুর রহমান, আখলাকুর রহমান, সাজ্জাদুর রহমান, আব্দুল হক, ইন্তাজ আলী, রসরাজ বৈদ্য, মিজানুর রহমান, মানিক পাল, সৈয়দ আব্দুল হান্নান, সৈয়দ আতাউর রহমান, সিরাজুল ইসলামসহ আরো অনেকে। এছাড়া স্বাধীনতা যুদ্ধে জগন্নাথপুরের বিপুল সংখ্যক ছাত্র, যুবক, শিক্ষক, কৃষক, আইনজীবী অংশ নেন। প্রবাসীরাও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। জগন্নাথপুর উপজেলায় ৬ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও ১৩ জন যোদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় পাওয়া যায়। শ্রীরামসি গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে ১৯৮৬ সালে একটি স্মৃতিফলক নির্মিত হয়। রানীগঞ্জ বাজারে গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে ১৯৮৭ সালে রানীগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে আরেকটি স্মৃতিফলক নির্মিত হয়।
জগন্নাথপুরে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলনকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা মির্জা আব্দুল মতিনের বীরত্বপূর্ণ দিনগুলো সম্পর্কে জানা গেছে, তিনি ১৯৭১ সালে জগন্নাথপুর থানায় প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। মির্জা আব্দুল মতিন যুদ্ধকালীন সময়ে জগন্নাথপুর, বিশ্বনাথ, নবীগঞ্জ, বালাগঞ্জ ও ছাতক থানার দক্ষিণাংশের অসংখ্য তরুণ ও যুবকদের উদ্বুদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং এর উদ্দেশ্যে ভারত সীমান্তে পাঠান। একসময় পাকিস্তানী বাহিনীর সহযোগিতায় পাকসেনারা কয়েক’শ আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে জগন্নাথপুর দখলে নেয়। এ সময় যথেষ্ট শক্তি না থাকার কারণে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের মতো তিনিও বাধ্য হয়ে জগন্নাথপুর ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। এ সুযোগে স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় পাক হানাদাররা তাঁর এবং আত্মীয়-স্বজনের পাকা ঘরসহ ৬টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে বিধ্বস্ত করে দেয়। তারা ব্যাপক লুটপাট চালায়। অন্যদিকে, তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কুশিয়ারা নদী দিয়ে পাকবাহিনীর যাতায়াত বন্ধ করার লক্ষ্যে মার্কুলীসহ বিভিন্ন স্থানে আক্রমণ করেন। এ সময় উপজেলার চিলাউড়া-হলদিপুর ইউনিয়নের বেতাউকা গ্রামে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর অনেক হতাহত হলে এক নৌকার মাঝি গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে উদ্ধার করেন। পরে তিনি সুস্থ হয়ে উঠলে তাঁর নেতৃত্বে দিরাই থানা আক্রমণ করা হয়। তবে ভারী অস্ত্রের অভাবে থানাটি দখলে নিতে না পারলেও তাঁদের আক্রমণে অনেক পাকসেনা ও রাজাকার নিহত হয়। দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করার সময় টেকেরঘাট সেক্টরের মেজর বাট, মেজর মুসলেহ উদ্দিন, ক্যাপ্টেন বার্মা, সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত, আব্দুজ জহুর ও আব্দুল হক এম.সি.এ’র সাথে যোগাযোগ রেখে তাদের নির্দেশ মতো তিনিও কাজ করেন। দেশ স্বাধীনের পর তিনি তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের নিকট থেকে একটি চিঠি পান। চিঠিটি পেয়ে আব্দুল হক এম.সি.এ ও কর্ণেল শওকতের সাথে দেখা করেন। পরে তাদের অনুরোধে জগন্নাথপুর থানার প্রথম বেসামরিক প্রশাসকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এই থানার দুই শতাধিক রাজাকারের নিকট থেকে যখন অস্ত্রশস্ত্র নেওয়ার প্রচেষ্টা চালানো হয় তখন পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে যাওয়ার উপক্রম হলে তাঁর অনুরোধে কর্ণেল শওকত তৎকালীন ক্যাপ্টেন হেলালকে জগন্নাথপুরে পাঠান। অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে উঠলে শরনার্থীরা দলে দলে দেশে আসতে শুরু করেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম কর্মী আব্দুল হক এম.সি.এ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। এর পরিপ্রেক্ষিতে সুনামগঞ্জের এম.সি আব্দুর রইসের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ সম্ভব না হওয়ায় সিলেটের এম.সি.এ দেওয়ান ফরিদ গাজী চিঠিপত্র ও তাঁর নিজস্ব প্রতিনিধি মারফত তাঁর সাথে যোগাযোগ করেন। বায়াত্তরের ৫ জানুয়ারি বীর মুক্তিযোদ্ধা মির্জা আব্দুল মতিনকে পেশাগত জরুরী কাজে ঢাকা হাইকোর্টে যাওয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়। তাই সুনামগঞ্জের দেওয়ান উবেদুর রেজা চৌধুরী ও আব্দুজ জহুর এম.সি.এ. এর সামনে আব্দুর রইস এম.সি.এ’কে জগন্নাথপুরের কার্যভার গ্রহণের অনুরোধ করেন। ১১ জানুয়ারি জগন্নাথপুরে পৌঁছে স্থানীয়ভাবে কমিটি গঠনের পর তিনি তাকে অবসর দিবেন বলে জানান। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, কল্যাবেটারস অর্ডিন্যান্সে কতিপয় মুক্তিবাহিনী বীর মুক্তিযোদ্ধা মির্জা আব্দুল মতিনও তাঁর ভাই স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত লন্ডন ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন ছাত্র মির্জা আব্দুল ওয়াহিদকে গ্রেফতার করে থানা হাজকে বন্দী করে। এ সময় আব্দুর রইস এম.সি.এ’র সাথে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তিনি ব্যর্থ হন। সেদিন রাত সাড়ে ৮ টার দিকে মুক্তিযোদ্ধার নাম ব্যবহার করে কতিপয় লোক তাঁর স্বজনদের ৬টি বাড়িতে হামলা চালায়। হামলা চালিয়ে তারা শিশু সন্তানসহ ৫৮ জন নারী পুরুষকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে ব্যাপক লুটপাট চালায়। লুটপাটকারীরা তাদের শেষ সম্বল মাত্র ১’শ টাকাও নিয়ে যায়। পরদিন তাদেরকে সুনামগঞ্জ জেলে পাঠানো হয়। কিন্তু অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় জেলা জজের নির্দেশে মুক্তি দেওয়া হয়। ৭১ এর এই বীর মুক্তিযোদ্ধা মির্জা আবদুল মতিন এর স্মৃতি অম্লান রাখতে তাঁর নামে জগন্নাথপুরে কোনো স্থাপনা বা সড়ক নামকরণের দাবি জানিয়ে আসছেন জগন্নাথপুরের সচেতন মহল।