প্রকাশিত: ২:০৭ অপরাহ্ণ, মে ১২, ২০২২
লেখা সংগৃহীতঃ
সম্প্রতি পটকা মাছ খেয়ে সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলায় একজন অন্তঃসত্ত্বা মায়ের মৃত্যু সংবাদ আমাদের শোকাহত করেছে। বিষক্রিয়ায় এ ধরনের দুর্ঘটনার খবর বিচ্ছিন্নভাবে প্রায় প্রতিবছর গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়ে থাকে। এসব ঘটনার পেছনে মূলত ভোক্তার অজ্ঞতা ও অসাবধানতা কাজ করে। এ নিয়ে গণসচেতনতা তৈরিতে ইতঃপূর্বে সরকারের তরফ থেকে নানা কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে। তবুও মাঝেমধ্যে এ ধরনের দুর্ঘটনার খবর প্রকাশিত হয়।
পটকা মাছ (সামুদ্রিক) জাপানে একটি দামি, সুস্বাদু ও অভিজাত শ্রেণির মাছ হিসাবে পরিচিত। পটকা মাছ তাদের ঐতিহ্যের অংশ। কোনো কোনো জাপানি পটকা মাছকে কাজের উদ্যম সৃষ্টির প্রতীক হিসাবে মনে করে। জাপানিরা বিস্তর গবেষণার মাধ্যমে তাদের পটকার কোন প্রজাতি কোন এলাকায় কোন সময় বিষাক্ত হয়, তা ইতোমধ্যে জেনে গেছে।
তারা মূলত চাষের পটকা খায়। হোটেল-রেস্তোরাঁয় পটকার মেন্যু তৈরির জন্য রয়েছে লাইসেন্সধারী বিশেষ শেফ। তবুও পটকা মাছ খেয়ে জাপান, কোরিয়া, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, চীন ও মেক্সিকোতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে থাকে; যদিও সে সংখ্যা এখন একেবারেই হাতেগোনা।
বাংলাদেশে সাধারণত দুই ধরনের পটকা মাছ পাওয়া যায়-স্বাদুপানির ও লোনাপানির পটকা। স্বাদুপানির পটকা আকারে লোনাপানির পটকার চেয়ে অনেক ছোট। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে পটকা মাছের বিষাক্ততা নিয়ে প্রায় দুই দশক আগে প্রাথমিক কিছু গবেষণা করা হয়েছিল। গবেষণায় আমাদের স্বাদুপানিতে দুই প্রজাতির পটকা (Tetrodon cutcutia I Chelenodon patoca) পাওয়া গেছে এবং উভয় প্রজাতির পটকাই কমবেশি বিষাক্ত।
কিন্তু আমাদের সামুদ্রিক পটকার বিষাক্ততার মাত্রা সম্পর্কে এখনো ধারণা সীমিত। গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে ইনস্টিটিউট থেকে পরবর্তীকালে এ বিষয়ে একটি লিফলেটও প্রকাশ করা হয়।
সাধারণত প্রজনন মৌসুমে (মে-জুলাই) পটকা মাছ বেশি বিষ বহন করে থাকে। পটকা মাছ সাধারণত Tetrodotoxin (TTX) নামক বিষ বহন করে। তবে এলাকাভেদে কোনো কোনো সময় Saxitoxin (STX) নামক বিষ বহন করারও নজির আছে। পটকার চামড়া, যকৃৎ ও গোনাডে সাধারণত অধিক বিষ থাকে। পটকা মাছের বিষাক্ততা প্রজাতি, স্থান ও ঋতুভেদে ভিন্নতর হয়।
উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে পটকা মাছের যে প্রজাতিটি মারাত্মক বিষাক্ত, জাপানে সেটা ততটা বিষাক্ত নাও হতে পারে। অনুরূপভাবে, বৈশাখ মাসে যে পটকা মাছটি বিষাক্ত থাকে, কার্তিক মাসে তাতে ততটা বিষ নাও থাকতে পারে। তাই অপেক্ষাকৃত কম বিষ ধারণকৃত সময়ে পটকা মাছ খেয়ে ভোক্তার হয়তো কোনোরূপ দুর্ঘটনা ঘটেনি; কিন্তু অজ্ঞতাবশত অধিক বিষ বহনকালে একই পটকা খেয়ে তার মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এলাকাভেদে বিষাক্ততার তারতম্যের কারণেও একই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকে।
সামুদ্রিক পটকার ক্ষেত্রে (Tetrodotoxin, TTX বহনকারী) মানুষের জন্য বিষাক্ততার মাত্রা হচ্ছে প্রতি গ্রামে ১০ মাউস ইউনিট (গট, বিষাক্ততার একক) অর্থাৎ, পটকার প্রতি ১ গ্রাম অংশে যদি ১০ গট বিষ থাকে, তবে তা মানুষের জন্য বিষাক্ত। এ পরিমাণ বিষ খেলে তার মধ্যে বিষক্রিয়া শুরু হবে এবং এভাবে যদি একসঙ্গে ১০ হাজার গট বিষ একজন সুস্থসবল মানুষ খেয়ে ফেলে তবে নির্ঘাত মৃত্যু।
একইভাবে স্বাদুপানির পটকার ক্ষেত্রে প্রতি গ্রামে ৩ গট বিষ (Saxitoxin, STX) থাকলে তা বিষাক্ত এবং ৩ হাজার গট একসঙ্গে খেলে মৃত্যু অবধারিত। এ থেকে সহজেই অনুমেয় যে, সামুদ্রিক পটকার চেয়ে স্বাদুপানির পটকা অধিকতর বিষাক্ত। উপরন্তু, পটকার মধ্যে কোনটি বিষাক্ত এবং কোনটি বিষাক্ত নয় এবং কোনটি কোন সময়ে বিষাক্ত-এ ধরনের যথেষ্ট তথ্য আমাদের জানা নেই। স্থানভেদে বিষাক্ততার তারতম্য কতটুকু, তা-ও আমরা জানি না। তাই দুর্ঘটনা এড়াতে পটকা খাওয়া থেকে আমাদের বিরত থাকাই উত্তম।
গবেষণায় দেখা যায়, কোনো কোনো সামুদ্রিক পটকা প্রতি গ্রামে ৪০০০ গট পর্যন্ত বিষ (TTX) বহন করে থাকে; অর্থাৎ একজন সুস্থসবল ব্যক্তি এরূপ বিষাক্ত পটকার ৩ গ্রাম খেলেই বিষাক্রান্ত হয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে মারা যাবে। অনেকের ধারণা, পটকা মাছ রান্না করলে এর বিষাক্ততা নষ্ট হয়ে যায়। এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। অত্যধিক তাপে বিষের উপাদান (Chemical Structure) এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় রূপান্তর হতে পারে; কিন্তু এতে বিষাক্ততার খুব একটা তারতম্য হয় না।
রোগীর দেহে পটকা মাছের বিষক্রিয়ার মাত্রা গৃহীত বিষের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে। স্বাদুপানি ও লোনাপানির পটকার বিষাক্ততার লক্ষণ রোগীর দেহে প্রায় একই রকম। পটকা মাছের বিষকে Neurotoxin কিংবা Sodium channel blocker বলা হয়। পটকা মাছের বিষ (TTX; m.w. 319) মানবদেহের নার্ভ সেলের Voltage-gated sodium ion channel-এর সঙ্গে শক্তিশালী বন্ধন তৈরি করে।
ফলে হার্টে সোডিয়াম প্রবেশের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। এতে মানবদেহে ইলেকট্রোলাইটিক্যাল ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়। বিষাক্ততায় ১ ঘণ্টার মধ্যে পর্যায়ক্রমে রোগীর ঠোঁট ও জিহ্বায় জড়তা, মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব, মুখে শুষ্কতা, মাংসপেশিতে ব্যথা প্রভৃতি নানা উপসর্গ দেখা দিতে পারে। পর্যায়ক্রমে রোগী পক্ষাঘাতগ্রস্ত হতে থাকে। পরিণামে ৪ থেকে ৬ ঘণ্টার মধ্যে শ্বাসকষ্টে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে।
তাই প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগীকে স্থানীয় হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হবে। এক্ষেত্রে পাকস্থলী পরিষ্কারসহ অন্যান্য symptomatic চিকিৎসা প্রদান করা হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, পটকা মাছের বিষাক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় অদ্যাবধি কোনো ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়নি।
অতএব, মৃত্যুঝুঁকি এড়াতে সব ধরনের পটকা মাছ খাওয়া থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে। বরং এর বিষ আইসোলেট করে আমরা তা বিদেশে রপ্তানি করতে পারি। ওষুধশিল্পে এর বিষ খুবই দামি।
ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ : মহাপরিচালক, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহ
নির্বাহী সম্পাদক ও প্রকাশক – তৌফিকুল আম্বিয়া টিপু
বার্তা সম্পাদক- হুমায়ূন কবীর ফরীদি
উপদেষ্টা: হারুন মিয়া
বাংলাদেশ কার্যালয়- কলকলিয়া বাজার, জগন্নাথপুর, সুনামগন্জ।
প্রধান কার্যালয়- ৮২৪ মেইন স্রীট, মেনচেষ্টার, কানেকটিকাট- ০৬০৪০, যুক্তরাষ্ট্র।
ফোনঃ ০১৭১৭৯৩১৬৫৮(বিডি) +১৮৬০৭৯৬৭৮৮৮(ইউএসএ)
ইমেইলঃ usbanglabarta@gmail.com
Design and developed by Web Nest